বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০২:৪৮ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম: আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের ৪৬ বছর পূর্ণ হল আজ। মুক্তির জয়গানে মুখর কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আজ স্মরণ করবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সেই অকুতোভয় বীরদের, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
জাতীয় জীবনে নানা সংকট আর অনিশ্চয়তা থাকলেও আজ ভোরে পুব আকাশে যে নতুন সূর্য উঠবে তা স্মরণ করিয়ে দেবে দিনটি গৌরবের, আনন্দের, বিজয়ের। আজ এক আনন্দের দিন। এমনি এক দিনের প্রতীক্ষায় কেটেছে বাঙালির অনেক বছর। বহু কাক্সিক্ষত সেই দিনটির দেখা মিলেছিল দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
১৯৪৭ সালে ইংরেজদের শাসন থেকে এদেশ মুক্ত হলেও ফের বাধা হিসেবে দেখা দেয় পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর অন্যায় শাসন। বাঙালি বঞ্চিত হতে থাকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুট করে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে তোলা হয় সম্পদের পাহাড়। তাদের সে অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে দামাল বাঙালি। ধাপে ধাপে আঘাত হানতে থাকে শাসনযন্ত্রে। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ’৫৭-র স্বায়ত্তশাসন দাবি, ’৬২ ও ’৬৯-এর গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মার্চে দুরন্ত বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। ২৫শে মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী শুরু করে নির্মম নিধনযজ্ঞ। এরপর আসে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা। দখলদার বাহিনীকে বিতাড়নে শুরু হয় অদম্য সংগ্রাম। ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে জীবন দান করেন লাখ বাঙালি। অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর আসে সেই কাক্সিক্ষত বিজয়। সে সময়ের রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৪৫ বছর আগের এদিনে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী হাতের অস্ত্র ফেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল বিজয়ী বীর বাঙালির সামনে। স্বাক্ষর করেছিল পরাজয়ের সনদে। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয়ের দিনটিতে আনন্দের পাশাপাশি বেদনাও বাজবে বাঙালির বুকে। বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতায় জাতি আজ স্মরণ করবে জানা-অজানা সেসব লাখো শহীদকে। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল ভোগ করে পেরিয়ে গেল ৪৫টি বছর।
স্বাধীনতা অর্জিত হলেও গত ৪৫ বছর জাতির চলার পথ মসৃণ ছিলনা কখনো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়া, দারিদ্র্য ও দুর্নীতি থেকে মুক্তির সংগ্রামের পাশাপাশি একইভাবে চলেছে সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধের বিচার, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ আন্দোলন। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রবল বন্যা, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের। এই বন্ধুর পথপরিক্রমায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু শত বাধা-প্রতিবন্ধকতাতেও হতোদ্যম হয়নি এ দেশের সংগ্রামী মানুষ। হারায়নি সাহস। লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে অব্যাহত আছে বাঙালির এগিয়ে যাওয়া।
বিজয় উদযাপনে আজ সকাল থেকেই সারা দেশে পথে নামবে উৎসবমুখর মানুষ। শহীদদের স্মরণ করে বিনম্র শ্রদ্ধায় দেশের সব স্মৃতিসৌধ ভরিয়ে দেবে ফুলে ফুলে। সব বয়সী মানুষ সমবেত হবে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে। শ্রদ্ধার ফুলে ঢেকে যাবে সৌধের বেদি।
লাল-সবুজ পতাকা উড়বে আজ বাড়িতে গাড়ীতে, সব প্রতিষ্ঠানে। মাথায় থাকবে পতাকার রঙে রাঙা ফিতা। পতাকার রঙের পোশাকও থাকবে উৎসবে শামিল অনেকের পরনে। পতাকায় সজ্জিত করা হবে রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ। আজ সরকারি ছুটি। বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে গত কয়েক দিন আগে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভবনে করা হয়েছে আলোকসজ্জা। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলোকে সাজানো হয়েছে জাতীয় ও রঙ-বেরঙের পতাকা দিয়ে। হাসপাতাল, শিশুসদন ও কারাগারগুলোতে পরিবেশন করা হবে বিশেষ খাবার। বিজয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে জাতীয় সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। বাংলাদেশ বেতার, বিটিভি, বেসরকারি রেডিও এবং টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। রাজধানীর জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সম্মিলিত সামরিক বাহিনী বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ করবে।
বাণী: মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন।
সরকারী ও আওয়ামীলীগের কর্মসূচি: বরাবরের মতোই এবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস পালনের বিস্তারিত কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। গতকাল রোববার সরকারি এক তথ্যবিবরণীতে বলা হয়, ঢাকায় ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক দেবেন। বিকালে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মিলিত হবেন।
আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে সূর্যোদয়ের সময় দলীয় কার্যালয়ে সমাবেশ, ভোর ৬টা ৩৪ মিনিটে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ (প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে), ৮টায় ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের কর্মসূচি নিয়েছে। সকাল ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।
বিজয় র্যালী: বিজয় দিবস উপলক্ষে বিজয় র্যালী করবে আওয়ামীলীগ। ঢাকা মহানগরীর সকল থানা শাখা আওয়ামীলীগের নেতা ও এমপিগণ নিজ নিজ এলাকা থেকে বিজয় শোভাযাত্রা সহকারে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত হবেন এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক ক্ষণ বিকাল ৩টায় শিখা চিরন্তনে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে বিজয় র্যালী শুরু হবে।
টুঙ্গিপাড়ার কর্মসূচি: সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ও এসএম কামাল হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করবেন।
এছাড়া শনিবার বিকাল ৩টায় রাজধানীর ফার্মগেট খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা করবে আওয়ামীলীগ। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামীলীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলোচনায় জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীগণ বক্তব্য রাখবেন। বিজয় দিবস উপলক্ষে রবিবার সন্ধ্যা ৬টায় ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে আওয়ামীলীগ। এতে দেশের প্রখ্যাত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করবেন।
বিএনপির কর্মসূচি: বিএনপির পক্ষ থেকেও সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সকাল ৯টায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সাভার স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্যদিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান জানাবেন। এরপর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সাভার থেকে ফিরে শেরেবাংলা নগরের বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এছাড়াও মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে দলটি বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর গুলিস্তানে বশিরউদ্দিন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা করে। এতে দলের সিনিয়র নেতাগণ ও দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীগণ আলোচনায় অংশ নেন।
বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচি: মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয়পার্টি, ওয়ার্কার্সপার্টি, গণফোরাম, ন্যাপ, জাকেরপার্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা, মুক্তিযোদ্ধা ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, কৃষকলীগ, জাতীয় গণতান্ত্রিকলীগ, আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, অগ্রণীব্যাংক এ্যাম্পøয়িজ ইউনিয়ন, বিজয় ’৭১ প্রভৃতি সংগঠনও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।